চকবাজার ছিল বারোয়ারি মালপত্রের আড়ত। এখন তা বারোয়ারি মৃত্যুর নরক। গোটা পুরান ঢাকাই মৃত্যুফাঁদ। গোটা ঢাকাতেই এখন বসেছে গণমৃত্যুর চকবাজার। পুরান ঢাকার পুরান গর্ব, খাদ্যের বাহার, তার প্রাণবান রসিক মানুষ, তার টগবগ করা জীবন—সব আজ পুড়ে গেছে।

কেমনে সইব? কার কাছে বিচার দেব? আর কত, আর কত, আর কত হে খোদা? আর কত সইবে হে সর্বংসহা জাতি?

বাতাসে মানুষ পোড়ার গন্ধ
নরকেই যদি বাস, তবে আগুনে কেন ভয়? আমাদের কি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি? আমরা কি অভ্যস্ত হয়ে যাইনি? তাজরীন ফ্যাশনস পোড়ার পর গিয়েছিলাম। পোড়া মানুষের চিহ্ন, গলে যাওয়া অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন বাটি, মেশিন, পাখা, স্যান্ডেল দেখেছি। অজস্র আধপোড়া পরিচয়পত্র, ছবি নিয়ে এসেছিলাম। আমার টেবিলের ড্রয়ারে সেগুলো এখনো তালাবদ্ধ আছে। খুললেই পোড়া মাংসের ঘ্রাণ আসে। ঢাকার বাতাসে আজ মানুষ পোড়ার গন্ধ।

নন্দিত নরকে নরকবাসের প্রশিক্ষণ
সয়ে নিয়েছি তো! রানা প্লাজার নরকও তো দেখেছি। জীবনযন্ত্রণা সয়ে যাওয়া মানুষের বীভৎস মৃত্যুযন্ত্রণাও সয়ে যায়। চুপচাপ মরে যাব বলেই চুপচাপ থেকে যাই জীবনের পুরোটা সময়। মরলে তো সব কষ্টের শেষ।

অভ্যাস হয়ে যায়। নরকবাসের নিয়তি হলে, নিরুপায় হলে সয়ে যায়। খাঁচার মুরগিরা যেমন জবাই করতে নেওয়ার আগে পর্যন্ত কক কক করে, কামড়াকামড়ি করে, আমরাও তেমনই করে যাব। তারপর জীবনমৃত্যুর ম্যানেজারের বদখেয়ালে কিংবা ইচ্ছায় একসময় ভবলীলা সাঙ্গ হয়। নরকে এসব অভ্যাস রপ্ত করা জরুরি। সেটাই বাংলাদেশীয় টেকনিক। নরকবাসের ট্রেনিংটা লাগাতার রাখার জন্য ওপরতলার মহাজনদের তাই ধন্যবাদ জানাই।

ছয় বছর আগে এই পুরান ঢাকারই নিমতলীর কেমিক্যাল ডিপোতে আগুন লেগে শতাধিক মানুষের অঙ্গার হওয়ার পরও সত্যিকার প্রতিকার না করা হলো সেই ট্রেনিং। তাজরীনের মালিককে বিচারের নামে দিন গুজরান করার বন্দোবস্ত দেখে যাওয়া হলো সেই ট্রেনিং। রানা প্লাজার কেয়ামতের পরও কারখানাগুলোকে নিরাপদ না করা হলো ট্রেনিং। মহাজনেরা এভাবে আমাদের তৈরি করে আমাদেরই গণমৃত্যুর জন্য। আগুনে বা পানিতে, গাড়িতে বা বিমানে, ধসে বা পুড়িয়ে—সবভাবেই মরার জন্য আমাদের প্রস্তুত করা হয়েছে।

উন্নয়নে কী কাজ যদি জীবন না বাঁচে?
গত সপ্তাহেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বিভীষিকাময় আগুন লাগল। গত রাতে পুড়ল পুরান ঢাকার চকবাজার। শতের নিচে আমরা মরি না। বিশ্বের মধ্যে উন্নয়নের কৃতিত্বের মতো নিয়মিতভাবে শত বা হাজারে মরার শিরোপাটাও আমাদেরই হোক।

এটা আগুনের মাস। আরও আগুন লাগবে। আরও মানুষ পুড়ে কাবাব হবে এবং হচ্ছে—ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে। ঘিঞ্জি খুপরির মতো ঘরবাড়িতে যারা পয়-পরিজন নিয়ে তিলে তিলে সংসার সাজিয়েছিল যারা, তাদের অনেকে আবারও পুড়ে কয়লা হবে। জীবন যেমন নারকীয়, তেমন নারকীয় মৃত্যুই আমাদের জন্য বরাদ্দ।

আমাদের জন্য বরাদ্দ অসীম যানজটের রাস্তা, যা দিয়ে জীবন বাঁচানোর অ্যাম্বুলেন্স, দমকল কিংবা সাহায্যকারী মানুষ—কিছুই সময়মতো পৌঁছতে পারবে না। আমাদের জন্য রয়েছে সরু গলি, শুকানো পুকুর; তাই দমকলের আধুনিক গাড়ি কোনো কাজেই আসবে না। কেনাকাটায় আমরা বড়ই সেয়ানা। অপ্রয়োজনীয় জিনিস আর বাহিনীতে ভরপুর থাকবে রাষ্ট্রটা। সবচেয়ে দামিটা সবচেয়ে বেশি দামে কিনে আমরা সাজিয়ে রাখব খেলনার মতো। তারপর এক দুর্ভাগ্যের প্রহরে যখন ঢাকার ঘনবসতি পুড়ে যাবে, তখন গাড়িগুলো, যন্ত্রগুলো আমাদের ভেংচি কাটবে। আমরা বিরাট বিরাট ভবন আর সেতু বানাব, কিন্তু নিরাপদ ও সভ্য নগর বানাতে কিছু তো করবই না, যতভাবে এই নগরের প্রাণ, প্রকৃতি ও নিরাপত্তা নষ্ট করা যায়, তাতে মদদ দেব। জীবন চলে না এখানে, জীবন জিয়ে না এভাবে। মৃত্যুই এখানে সবচেয়ে সুলভ, গতিশীল ও নিশ্চিত। জীবন এখানে সবচেয়ে সস্তা।

নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিকেরা
আমরা এক নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিকের জীবন পেয়েছি। আমরা কত ভাগ্যবান, জীবনে যে স্বীকৃতি পাই না, মরার পর তা পাই। পাই শোকবার্তা, কভারেজ ও প্রতিশ্রুতির হাওয়াই মিঠাই।

এভাবে চলতে পারে না বলবেন? চলছে তো। ঢাকা মহানগর যে এক গণবিধ্বংসী মৃত্যুফাঁদ তা কে জানত না? যাঁরা বহুকাল থেকে করি করি করছেন, তাঁরা এবারও বলবেন এবার একটা কিছু করতেই হইবে। এই ‘একটা কিছু’ সাগর-রুনি হত্যাকারীদের কায়দায় সোনার হরিণের মতো পালিয়ে বেড়াবে। প্রতিবার মানুষের হুতাশন ঠান্ডা করতে চমৎকার সব বিবেকের জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। উদ্বেগ আর শোকে বাতাস ভারী হলেও লাশের লোবানের ঘ্রাণ চাপা পড়ে না। এই দেশে মানুষের চেয়ে মশা-মাছিরাই বেশি নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। ছয় বছর আগে নিমতলীর আগুনে ১১৭ জনেরও বেশি মানুষের গণমৃত্যুর পর লিখেছিলাম,

‘এমন মৃত্যু কি তাহলে আমাদের বোধোদয়ের টনিক? প্রতিটি বিপর্যয় কেবল পরের বিপর্যয়েরই পদধ্বনি। জীবনের মতো মৃত্যুও এখানে সুলভ, সহজ ও তুচ্ছ। আগুনে পুড়ে, নদীতে ডুবে, ভবন ধসে, বিষক্রিয়াসহ কত তুচ্ছ কারণেই না দফায় দফায় মানুষ মরে। মহিমাহীন এসব মৃত্যুতে কিছুই কি তবু বদলায়? বদলাবে? মৃত্যুর রাজত্বে জীবনের গান গাওয়ার অসম্ভব কসরতে আমরা জর্জরিত। তবু প্রতিদিনকার জীবনের পিছু ধাওয়া করতে করতে সম্ভাব্য সব বিপদের ভয়কে আমরা হজম করে ফেলি। ঢাকাবাসীর থেকে তাই সাহসী ও অদূরদর্শী আর কে আছে? কিন্তু “দিনে দিনে যত বাড়িয়াছে দেনা”, একদিন তার “শুধিতে হইবে ঋণ”…আগেকার যুগে ডুবন্ত জাহাজের ওজন কমাতে গরিব যাত্রী ও খালাসিদের সাগরে ফেলা হতো। সমস্যার ভারে ডুবতে থাকা ঢাকায় সবার আগে তেমনি খরচ হয়ে যায় ঝুঁকিতে থাকা স্বল্পবিত্ত মানুষেরা। বাকিরা মৃতের তালিকায় নিজেদের নাম না ওঠায় ভাবে, যাক আমি তো নিরাপদ! আমাদের শোকগুলো তাই মাছের মায়ের পুত্রশোকের মতো। বঙ্গজননীর তো ১৮ কোটি সন্তান। তার কটি বাঁচল আর কটি মরল তার হিসাব রেখে তাই কী লাভ?’ (ফারুক ওয়াসিফ, প্রথম আলো, মে, ২০১২)

সম্মিলিত বেকুবির শহীদ
রাষ্ট্র তো পাষাণ, তার মনন থাকতে নাই। পাথরে আঘাত করলেও প্রতিধ্বনি আসে, ফরিয়াদের কোনো জবাব আসে না। ওদিকে মৃত্যুর টালিখাতা হয়েছে সংবাদপত্র। আমাদের জাতীয় জীবন যেন এক লাইভ জানাজা। শোকে পাথর হলেও পাথরের মতো কঠিন সংকল্প জাগে না আমাদের। কপট আশ্বাস আর মিথ্যা আশায় বুঁদ হয়ে আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই, সরকার যদি থাকবে তবে মানুষ বারবার অকাতরে মরবে কেন? যা নিয়মিতভাবে হয়, তা দুর্ঘটনা নয়, তার দায় শোকের বন্যায় হালকা হওয়ার নয়। কবির সেই কথাই এখানে চিরসত্য: ‘সুখেরও লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু,/ অনলে পুড়িয়া গেল।/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে,/ সকলই গরলই ভেল।’

এটা নির্দয় এক ব্যবস্থার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। কেউ টাকা বানাতে আর কেউ টাকা বাঁচাতে চালিয়ে যাচ্ছে এমন সর্বনাশা কারবার। কে কাকে দোষ দেব? সাধারণ মানুষও অধিকার নিয়ে যেমন অসচেতন, দায়িত্ব নিয়েও তেমন। যা করা উচিত আর যা করা হয়, তার মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল—কোথাও নিয়মনীতির বালাই নেই। সমস্ত মনোযোগ যার যার নাকের ডগায় রাখতে গিয়ে সামনের অতল খাদটি কেউ দেখছি না। যেমন জনগণ, তেমন সরকারই তারা পায়। আমরা যেমন, আমাদের সরকার তেমন এবং আমাদের এই সাধের ঢাকা শহর আমাদের দায়িত্বহীন মানসিকতারই দর্পণ।

মানুষের তৈরি এই বাস্তবতারই শিকার নিমতলী বা চকবাজার বা রানা প্লাজা বা বেগুনবাড়ি বা…। আমরা আমাদেরই সম্মিলিত বেকুবির শহীদ।

জতুগৃহের দিনরাত্রি
জতুগৃহ নামে একটা বাস চলত একসময় ঢাকা শহরে। এখন আর দেখি না। সম্ভবত আগুনে পুড়ে গেছে। ঢাকা মহানগর নিজেই এখন পৌরাণিক জতুগৃহ। মহাভারতের কাহিনিতে পঞ্চপাণ্ডবের বনবাসে জতুগৃহ নামে এক ঘরে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেটা আসলে ছিল ফাঁদ। মেঝে থেকে চাল পর্যন্ত পুরোটা মোড়া ছিল দাহ্য বস্তু দিয়ে, যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে নিমেষে পুড়িয়ে মারা যায়। পাণ্ডবকুলের পাঁচ ভাই সেই ষড়যন্ত্র বুঝে কয়েকজন আদিবাসীকে কৌশলে সেই ঘরে ঢুকিয়ে নিজেরা প্রাণে বাঁচেন। পুড়ে মরে সেই নিরীহ মানুষগুলো। ওরা জানত না জতুগৃহ বাঁচার আশ্রয় নয়, দহনের ফাঁদ। আজ উন্নতি আর সুখের স্বপ্নে ভিড় জমানো ঢাকাবাসীর সে রকম ফাঁদে পড়ার দশা হয়েছে।

মৃত্যুর সুশাসনে পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি
ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলেক্সেই ডি তকুইভিল বলেছিলেন, দীর্ঘদিন যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা মানুষ বিকল্পের সন্ধান পাওয়া মাত্রই সমস্যাগুলোকে অসহনীয় মনে করতে থাকে এবং তাকে বদলানোর জন্য কোমর কষে নামে। আমাদের এখানে হয়েছে উল্টোটা, দীর্ঘদিন অসুবিধার মধ্যে থাকতে থাকতে, পরিবর্তনের আশা ধূলিসাৎ হতে দেখতে দেখতে আমরা এখন সব সওয়া মহাশয়ে পরিণত হয়েছি। আশার মৃত্যু হলে ব্যক্তিগত সুবিধাবাদ জন্ম নেয়। সার্বিক সমস্যা থেকে মন সরিয়ে আমরা অনেকেই যেভাবে একা একা সুখে থাকার ইঁদুরদৌড়ে নেমেছি, তাতে পতনই বরং ত্বরান্বিত হচ্ছে। ওদিকে বড় সাহেবেরা তো ভালোই আছেন। বিদেশে সাহেবপাড়া, বেগমপাড়ার বাসিন্দারা তো শাদ্দাদের বেহেশতে নিরাপদই আছেন।

এখনো ভাবুন কী করবেন। যাঁরা বিদেশে পালাতে পারবেন না, তাঁরা কোন মলমে নরকযন্ত্রণা ভুলবেন, ভুলবেন নেতা–নেত্রীদের কোন কোন গা-জ্বালানো কথায়। জীবন নয়, মৃত্যুই এখানে নিশ্চিত ও সুদক্ষ। মৃত্যুর সুশাসনে আমাদের জীবন এক পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here